নফস বলা হয়, মানুষের কামনা, বাসনা, চাহিদা ইত্যাদি-কে। এক কথায় যাকে বলা হয় প্রবৃত্তি। আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টির সময় তার স্বভাবে কতিপয় চাহিদা দান করেছেন। যেমন: আহারের চাহিদা, যৌবনের চাহিদা, কর্তৃত্বের চাহিদা, ক্ষমতার চাহিদা, লোভ-লালসা ইত্যাদি। সব গুলোকে এক কথায়, 'জৈবিক চাহিদা' বলা যায়। আর এগুলোই হলো নফস বা প্রবৃত্তি। নফস তার বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে আবার তিন প্রকার। মূলত নফস একটি, কিন্তু কাল পরিক্রমায়, স্বভাবের তাড়নায় ভিন্ন ভিন্ন রুপ ধারণ করে।
১. নফসে আম্মারাহ
২. নফসে লাওয়্যামাহ
৩. নফসে মুত্বমায়িন্নাহ
১. নফসে আম্মারাহ (প্রতারক আত্মা): অর্থাৎ যে নফস, মানুষকে কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক কামনার দিকে আকৃষ্ট করে। সব সময় খারাপ চিন্তা-ভাবনা পোষণ করিয়ে রাখে। সব সময় অনৈতিক চাহিদা পূরণার্থে ব্যস্ত রাখে। সব সময় খারাপ কাজে উৎসাহিত করে। এই নফস সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত আছে, আমি নিজেকে নির্দোষ মনে করিনা, মানুষের মন অবশ্যই মন্দ কর্ম-প্রবণ। কিন্তু সে নয়-যার প্রতি আমার রব অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয়ই আমার রব, অতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
২. নফসে লাওয়্যামাহ (অনুশোচনাকারী আত্মা): অর্থাৎ যে নফস, অন্যায় করার পর আমাদের হৃদয়ে অনুশোচনার উদ্রেক করে। কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন নফসে লাওয়্যামাহ -এর কথা উল্লেখপূর্বক কসম খেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, আরো শপথ করি সেই মনের, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়।
তাফসিরে মা'রিফুল কুরআনে নফসে লাওয়্যামাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নফসে লাওয়্যামাহ এমন একটি নফস-যা নিজের কাজকর্মের হিসাব নিয়ে নিজেকে ধিক্কার দেয়। অর্থাৎ, কৃত গোনাহ অথবা ওয়াজিব কর্মে ত্রুটির কারণে নিজেকে ভর্ৎসনা করে। সৎকর্ম সম্পর্কেও নিজেকে এই বলে তিরস্কার করে-"আরও বেশি সৎকাজ সম্পাদন করে উচ্চমর্যাদা লাভ করলে না কেন? হযরত হাসান বসরি রহি. নফসে লাওয়্যামাহ-এর তাফসির করেছেন, 'নফসে মু'মিনা'। তিনি বলেন, আল্লাহ'র কসম! মু'মিন তো নিজেকে সর্বদা সর্বাবস্থায় ধিক্কায় দেয়।
সৎকর্মসমূহেও আপন কর্মে অভাব ও ত্রুটি অনুভব করে। কেননা, আল্লাহ'র হক পুরোপুরি আদায় করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। ফলে, তার দৃষ্টিতে ত্রুটি থাকে এবং তার জন্যে নিজেকে ধিক্কার দেয়।
৩. নফসে মুত্বমায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা): অর্থাৎ যে নফস, সকল কালিমা থেকে মুক্ত এবং যাবতীয় মহৎ ভাবনায় পরিতৃপ্ত। সমস্ত খারাপ কর্ম-প্রবণতা থেকে মুক্ত। এ- প্রশান্ত আত্মা সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার পালনকর্তার কাছে ফিরে যাও-সন্তুষ্ট ও সম্ভোষভাজন হয়ে।
তাফসিরে মা'রিফুল কুরআনে নফসে মুত্বমায়িন্নাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে- এ- নফস আল্লাহ'র প্রতি তার সৃষ্টিগত ও আইনগত বিধি-বিধানে সন্তুষ্ট; আল্লাহও তার প্রতি সন্তুষ্ট। মহান রাব্বুল আলামিন এসব প্রশান্ত নফসকে সম্ভোধন করে বলেন-আমার বিশেষ বান্দাদের কাতারভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।
মূলত নফস একটি। অবস্থা ভেদে তার গুনে পরিবর্তন আসে। নফস আমাদের কর্মের দ্বারা পরিবর্তিত হয়। যদি তা লাগামহীন হয়ে যায়, তখন তা আম্মারায় পরিণত হয়। কিন্তু, যখন নফসে লাগাম পড়ানো হয়, তার গোলামী পরিত্যাগ করা হয়, তখন ধীরে ধীরে তা মুত্বমায়িন্নায় পরিনত হয়। এজন্যই বলা হয়-নফসে আম্মারাহ প্রায় সকলের মধ্যেই বিদ্যমান। তাই, আমাদের সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে-নফসে আম্মারাহকে নফসে মুত্বমায়িন্নায় ডাইভার্ট করা। যাতে নফসের গোলামী থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং তার প্ররোচনা থেকে নিজেকে দূরে রাখা যায়।
নফসকে কীভাবে ডাইভার্ট করবেন?
নফসে আম্মারা'র কাজ হচ্ছে, সর্বদা খারাপ কাজের প্ররোচনা দেয়া। নফসে আম্মারাহ সবসময় আপনাকে আমাকে খারাপ কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে। আর অন্য দিকে, নফসে মুত্বমায়িন্নাহ সর্বদা আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর হুকুম আহকাম এর প্রতি যত্নবান। সর্বদা এই নফস, আপনাকে আমাকে ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ দিতে থাকে।
সুতরাং, যার নফস, 'নফসে আম্মারা' সে সবসময় শুধু গোনাহের দিকেই ধাবিত হতে থাকে। আর যার নফস, 'নফসে মুত্বমায়িন্নাহ' সে সবসময় কল্যাণকর কাজের দিকেই এগিয়ে থাকে।
তাই, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে এবং বেশি বেশি নেক কাজ করতে আমাদের নফসে আম্মারাকে নফসে মুত্বমায়িন্নায় পরিণত করতে হবে। এখন কথা হচ্ছে-এই নফসে আম্মারাকে কীভাবে নফসে মুত্বমায়িন্নায় ডাইভার্ট করবেন?
বেশি কিছু নয়; শুধু নফসের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি। জানেন, সব কিছুর মূলে হচ্ছে এই নফস। এই নফসের চাহিদার ব্যাপারে যদি জোরজবরদস্তি করা যায়, তবে ঐ নফস, আম্মারা থেকে এমনি এমনি নফসে মুত্বমায়িন্নায় পরিনত হবে। আর এটা যদি করতে পারেন, তবে মনে করবেন-বিরাট এক অর্জন ছুঁতে যাচ্ছেন।
যাহোক, আমরা সবসময় নফসের চাহিদাকে প্রাধান্য দিচ্ছি।
শরিয়তের নির্দেশ-তোমরা জামাতের সাথে নামাজ আদায় করো। আর নফস বলে-আরে, আজকে বাসায় নামাজ পড়, একদিন বাসায় নামাজ পড়লে তেমন ক্ষতি হয়ে যাবে না; নামাজ আদায় হলেই তো হলো। এটাই হচ্ছে, আম্মারা'র কাজ। আপনার ক্ষেত্রেও যদি এরকম হয়ে থাকে-জামাতে যাওয়ার নিয়ত করলে ভিতর থেকে এরকম বাধা আসে, তবে বুঝে নিবেন, আপনার নফস এখন আর মুত্বমায়িন্নাহ -এর পর্যায়ে নেই; তা আম্মারায় পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় আপনার উচিত, নফসকে এসলাহ করা। তাকে আম্মারা থেকে মুত্বমায়িন্নায় ডাইভার্ট করা। নফসকে এসলাহ করার জন্য এরকম পরিস্থিতিতে আপনাকে নফসের ওপর জোরজবরদস্তি চালাতে হবে। তখন যদি আপনি নফসের বিরুদ্ধে জোরজবরদস্তি না করে, বাসায়-ই নামাজ পড়ে নেন, তাহলে কেমন জানি নফসের বিরুদ্ধে আপনি পরাজয় বহন করে নিলেন। আর যদি তার বিরুদ্ধে গিয়ে, তার সাথে লড়াই করে, মসজিদে যেতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি নফসের ওপর বিজয় অর্জন করলেন।
আপনি সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করে জিকির করবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় নফস বলে-'আরে উঠ, জিকির রাস্তায়ও করতে পারবি।' এই বলে নফস আপনাকে ধোঁকা দিতে চাইলো। আপনিও নফসের কথামতো উঠে গেলেন। নফসের চাহিদার প্রাধান্য দিয়ে দিলেন। দীনি আলোচনা চলছে। পাঁচ মিনিট শুনতেই অধৈর্য্য হয়ে গেছেন। অপরদিকে ক্রিকেট খেলা দেখছেন। ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হচ্ছে, মনে হচ্ছে মাত্রই খেলা দেখতে শুরু করলেন। কুরআন তেলাওয়াত করতে বসেছেন। পাঁচ মিনিট তেলাওয়াত করতেই মনে হয়, এক ঘন্টা তেলাওয়াত করে ফেলেছেন। অন্য দিকে প্রেমের উপন্যাস পড়তে বসেছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হচ্ছে; টের-ই পাচ্ছেন না-এগুলোই নফসে আম্মারার কাজ। এমতাবস্থায় নফসের ওপর জোরজবরদস্তি করে যদি তা ডাইভার্ট করতে না পারেন, তবে ধ্বংস অনিবার্য!
নফসের প্রলোভন, নফসের প্ররোচনা, নফসের ধোঁকা, নফসের গোলামী থেকে রক্ষা পেতে, অবশ্যই তাকে আম্মারা থেকে ডাইভার্ট করে মুত্বমায়িন্নায় রুপান্তর করতে হবে। অন্যথায় নফসের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে দুনিয়া আখেরাত উভয় জগত-ই হারাতে হবে।
তাই, নফসকে এসলাহ করার জন্য, আম্মারা থেকে মুত্বমায়িন্নায় ডাইভার্ট করার জন্য অবশ্যই নফসের উপর জোরজবরদস্তি চালাতে হবে। নফস যা চাইবে তা করা যাবে না; সবসময় এর বিপরীত করতে হবে। কারণ, নফসে আম্মারা সারাক্ষণ আপনাকে আমাকে খারাপ কাজের দিকেই উৎসাহ দিবে।

0 মন্তব্যসমূহ